সন্ধ্যা সাতটা। হাওড়া স্টেশন কোলাহলে ভরে আছে। স্টেশন ঘড়ির কাঁটা ঠিক সাতটা ছুঁতেই ‘গুপ্তসাগর এক্সপ্রেস’ ধীরে ধীরে প্ল্যাটফর্ম ছাড়তে শুরু করল। এই ট্রেনের গন্তব্য পুরুলিয়া।
অর্ণব বসে আছে জানালার ধারে। তার হাতে একটা পুরনো খাম—সেখানে শুধু একটা ঠিকানা লেখা:
“বিজনপুর, পুরুলিয়া। সন্ধ্যা ১০টা। একা এসো।”
এই চিঠিটা পেয়েছে সে গতকাল, কিন্তু কে পাঠিয়েছে, তা জানা নেই।
অদ্ভুত সহযাত্রী
ট্রেনের কামরায় যাত্রীরা কম। একদম শেষের দিকে বসে আছে এক মধ্যবয়সী লোক, বড় একটা শাল গায়ে জড়ানো। পাশে বসে আছে এক বৃদ্ধা, যার চোখদুটি অস্বাভাবিকভাবে চকচক করছে।
হঠাৎই বৃদ্ধা অর্ণবের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললেন,
“তুমি কি জানো, এই ট্রেনে আজ একটি খুন হবে?”
অর্ণব চমকে গেল।
“কি বলছেন?”
বৃদ্ধা আর কিছু বললেন না, শুধু হেসে উঠলেন। সেই হাসিতে একটা ভয়ানক শীতলতা ছিল।
রহস্যের জাল
ট্রেন এগিয়ে চলল। হঠাৎই লাইট নিভে গেল। কামরায় চিৎকার শুরু হলো। অন্ধকারের মধ্যে কারো গলা কাটা পড়ার শব্দ শোনা গেল।
লাইট আসতেই দেখা গেল, সেই শাল জড়ানো লোকটি মেঝেতে পড়ে আছে। তার গলা থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।
অর্ণব স্তম্ভিত! তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, সেই বৃদ্ধা কোথাও নেই!
গন্তব্যের পথে
ট্রেন থামল পুরুলিয়ায়। স্টেশনে নেমে অর্ণব ঠিকানার দিকে এগোল। রাস্তা জনশূন্য।
একটা পুরনো বাংলোর সামনে এসে দাঁড়ালো সে। দরজায় একটা নামপ্লেট: “বিজনপুর ভবন”।
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা এক নারীর ছায়া দেখতে পেল সে।
নারী ধীরে ধীরে কাছে এলো।
“আমি তানিয়া। তুমি সঠিক সময়ে এসেছো। এবার সত্যিটা জানবে!”
অর্ণবের গলা শুকিয়ে গেল।
“সত্যি? কিসের সত্যি?”
তানিয়া ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে এল। চোখ দুটো যেন অন্ধকারে জ্বলছে।
“এই বাংলোয় এক ভয়ঙ্কর সত্য লুকিয়ে আছে, যা জানলেই তোমার জীবন বদলে যাবে!”
অর্ণব পেছনে সরে এল।
“তুমি কে? আমায় এই ঠিকানায় আসতে বললে কেন?”
তানিয়া একটা পুরনো ছবি বাড়িয়ে দিল। ছবিতে তিনজন—একজন অর্ণবের বাবা, একজন অপরিচিত লোক, আর একজন সেই বৃদ্ধা, যাকে সে ট্রেনে দেখেছিল!
“এই বৃদ্ধাকে চেনো?” তানিয়া ফিসফিস করে বলল।
অর্ণব চমকে উঠল।
“এই বৃদ্ধা তো ট্রেনে ছিল! সে কি তোমার আত্মীয়?”
তানিয়া হাসল। কিন্তু সেই হাসিতে ভয় লুকিয়ে ছিল।
“সে আমার দাদি ছিল… কিন্তু পাঁচ বছর আগে মারা গেছে!”
ভয়ঙ্কর অতীতের দরজা
অর্ণবের শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল।
“কী? তাহলে আমি কাকে দেখলাম?”
তানিয়া তার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল এক পুরনো ঘরের দিকে। ঘরটিতে একটা পুরনো কাঠের টেবিল। তার উপর ধুলো জমে আছে, কিন্তু এক পাশে রাখা একটা রক্তমাখা ছুরি যেন নতুন।
“এই ছুরিটা চেনো?”
অর্ণব মাথা নাড়ল।
তানিয়া ধীরে ধীরে বলল,
“তোমার বাবার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিল অজিত দত্ত। কিন্তু একদিন, তোমার বাবা আর অজিত দত্ত একসঙ্গে এই বাংলোয় আসে। তারপর…”
সে একটু থামল। অর্ণব অধৈর্য হয়ে বলল, “তারপর কী?”
তানিয়া গভীর শ্বাস নিয়ে বলল,
“সেই রাতেই অজিত দত্ত খুন হয়! আর তোমার বাবা ছিলেন শেষ ব্যক্তি, যিনি তাকে জীবিত দেখেছিলেন।”
ট্রেনের খুনি কে?
অর্ণবের মাথা ঘুরতে লাগল।
“তাহলে ট্রেনে যে খুন হলো, তার সাথে এসবের কী সম্পর্ক?”
তানিয়া কিছু বলল না। শুধু একটা পুরনো ডায়েরি এগিয়ে দিল।
অর্ণব ডায়েরিটা খুলে দেখল প্রথম পাতায় লেখা—
“এই হত্যার পেছনে আছে গুপ্তসাগর এক্সপ্রেসের রহস্য।”
তারপর পাতা উল্টাতেই একটা চিঠি পড়ে গেল:
“যদি তুমি সত্যি জানতে চাও, তবে রাত বারোটার পর ট্রেনের শেষ কামরায় অপেক্ষা করো। সে তোমার জন্য আসবে!”
সে কে? এই খুনের রহস্য কি ট্রেনের সঙ্গেই জড়িত? নাকি অর্ণবের নিজের পরিবারের সাথে?”
অর্ণবের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। ডায়েরির পাতাগুলো উল্টে যেতে যেতে হঠাৎ একটা জায়গায় চোখ আটকে গেল।
“গুপ্তসাগর এক্সপ্রেসে যে কেউ উঠতে পারে, কিন্তু সবাই নেমে যেতে পারে না। যারা সত্য জানে, তারা হারিয়ে যায়।”
মধ্যরাতের ট্রেন
তানিয়া ফিসফিস করে বলল, “তুমি কি সত্যিই সাহসী? তাহলে আজ রাত বারোটায় শেষ কামরায় ওঠো।”
অর্ণব দ্বিধায় পড়ে গেল। কিন্তু সে জানত, এই রহস্যের সমাধান করতেই হবে।
রাত তখন ১১:৫০। পুরুলিয়া স্টেশনের শেষ প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে অর্ণব। চারপাশ জনশূন্য।
হঠাৎ ট্রেনের হুইসেল বাজল। ধোঁয়া উড়তে লাগল, আর ট্রেন ধীরে ধীরে প্ল্যাটফর্মে এলো।
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার—এই কামরাটার জানালাগুলো ঢাকা, আর দরজা আপনা থেকেই খুলে গেল!
অর্ণব এক নিঃশ্বাসে উঠে পড়ল। ভিতরে ঢুকতেই দরজা বন্ধ হয়ে গেল, আর লাইট বন্ধ হয়ে গেলো!
চারপাশ নিঃশব্দ। শুধু ট্রেনের চলার শব্দ।
ভৌতিক যাত্রী
অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎ একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।
“তুমি ফিরে এসেছো… ঠিক যেমন তোমার বাবা ফিরেছিলেন।”
অর্ণব চমকে উঠে পেছনে তাকালো। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেই বৃদ্ধা, যে ট্রেনে ছিল!
কিন্তু এবার তার চোখ গাঢ় লাল! ঠোঁটের কোণে এক বিকৃত হাসি।
“তুমি জানো না, এই কামরায় যারা ঢোকে, তারা আর ফেরে না!”
অর্ণব হড়বড় করে বলল, “তুমি কে? আমার বাবার সাথে কী হয়েছিল?”
বৃদ্ধা ধীরে ধীরে বলল,
“তোমার বাবা খুনি ছিল না। কিন্তু সে এক ভয়ঙ্কর সত্য জেনেছিল। গুপ্তসাগর এক্সপ্রেসে গোপন কিছু পাচার হত। টাকা, স্বর্ণ, এমনকি মানুষও!”
“তুমি কি জানো, এই ট্রেনেই অজিত দত্ত খুন হয়েছিল?”
অর্ণব শিউরে উঠল।
বৃদ্ধা ফিসফিস করে বলল, “তোমার বাবা সব জেনেছিলেন, তাই তারা তাকেও সরিয়ে দিয়েছিল!”
শেষ মুহূর্ত
অর্ণব বুঝতে পারল, এই ট্রেন শুধু সাধারণ যাত্রী বহন করে না, এখানে লুকিয়ে আছে এক কালো ইতিহাস।
হঠাৎ করেই ট্রেন প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেল!
বৃদ্ধার শরীর ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে যেতে লাগল।
অর্ণব দৌড়ে দরজার দিকে গেল, কিন্তু দরজা খুলছে না!
ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখল, বাইরে কোনো স্টেশন নেই—শুধু ঘন অন্ধকার!
সকালবেলা…
পুরুলিয়া স্টেশনে কর্মীরা এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখল।
গুপ্তসাগর এক্সপ্রেস থেমেছে, কিন্তু শেষ কামরার দরজা খুলতেই দেখা গেল…
অর্ণব নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। মুখে এক অদ্ভুত আতঙ্কের ছাপ।
তার হাতে শক্ত করে ধরা সেই পুরনো ডায়েরি।
ডায়েরির শেষ পাতায় লেখা—
“এই ট্রেন শুধু মৃতদের নিয়ে যায়। যদি কেউ সত্য জানতে চায়, তবে সে হারিয়ে যাবে।”
পুরুলিয়া স্টেশনের লোকজন যখন অর্ণবকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করল, তখন তার হাতে ধরা ছিল সেই পুরনো ডায়েরি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ডায়েরির শেষের লেখা বদলে গিয়েছে!
এবার সেখানে লেখা:
“সত্য এখনও প্রকাশ পায়নি। ট্রেন আবার আসবে।”
অর্ণব ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে পেল। চারপাশে স্টেশনের কর্মীরা, পুলিশের এক উপপরিদর্শক, আর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তানিয়া।
তানিয়া উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “তুমি ঠিক আছো?”
অর্ণব ধীরে ধীরে উঠে বসল। তার মাথার মধ্যে সবকিছু ঝাপসা লাগছিল।
“আমি… আমি সেই বৃদ্ধাকে দেখেছিলাম। আর সে বলল, ট্রেন আবার আসবে!”
ট্রেনের নতুন সংকেত
পুলিশ এসে অর্ণবের বয়ান নিল। কিন্তু তারা বিশ্বাস করল না তার কথা।
“গুপ্তসাগর এক্সপ্রেসে কিছু হয়নি, স্যার। কোনো খুনের ঘটনা নেই, আর ট্রেন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ছিল।”
কিন্তু অর্ণব জানত, সে যা দেখেছে তা সত্যি।
ঠিক তখনই স্টেশনের ঘোষণায় একটা অদ্ভুত ঘোষণা হলো—
“বিশেষ ট্রেন সংকেত পাওয়া গেছে। রাত বারোটায় ট্রেন আসবে না, কিন্তু সিগন্যাল দেখা গিয়েছে। সতর্ক থাকুন।”
অর্ণব আর তানিয়া একে অপরের দিকে তাকাল।
পুরোনো রহস্য, নতুন শিকার
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। তানিয়া বলল, “আমার মনে হচ্ছে, ট্রেন আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছে।”
অর্ণব সায় দিল, “এবার আমাদের জানতে হবে, এর পেছনে কে আছে।”
তারা দু’জন রাত বারোটার জন্য অপেক্ষা করল।
ঠিক তখনই পুরুলিয়া স্টেশনের শেষ প্ল্যাটফর্মে কিছু একটা ঘটতে শুরু করল।
দূর থেকে ট্রেনের আলো দেখা গেল, কিন্তু ট্রেনের কোনো শব্দ নেই!
হঠাৎ করেই বাতাসের মধ্যে এক অদ্ভুত গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল, আর অর্ণব বুঝতে পারল—
এই ট্রেন শুধুমাত্র মৃতদের আনতে এসেছে!
রাত ঠিক বারোটা।
পুরুলিয়া স্টেশনের শেষ প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে অর্ণব আর তানিয়া।
দূর থেকে এক অদ্ভুত ট্রেনের আলো দেখা গেল। কিন্তু ট্রেনের কোনো শব্দ নেই!
চারপাশের বাতাস হিমশীতল হয়ে গেল, আর স্টেশনের বাতিগুলো একের পর এক ফ্লিকার করতে লাগল।
ভুতুড়ে ট্রেনের আগমন
“এটা কি সত্যিই ট্রেন?” তানিয়া ফিসফিস করে বলল।
অর্ণব কিছু বলার আগেই ট্রেন ধোঁয়া ছড়িয়ে সামনে এসে দাঁড়াল। দরজাগুলো আপনা-আপনি খুলে গেল।
তারা ধীরে ধীরে ট্রেনে উঠল। ভিতরে ঢুকতেই দরজা বন্ধ হয়ে গেল!
অতীতের ছায়া
ভিতরের আলো ম্লান। ট্রেনের কামরাগুলো ধুলোয় ভর্তি, যেন বহু বছর ধরে ব্যবহার হয়নি।
কিন্তু হঠাৎ করেই চারপাশের পরিবেশ বদলে গেল!
কামরার জানালার বাইরে এখন আর স্টেশন নেই।
বরং সেখানে দেখা যাচ্ছে… এক অন্যরকম দৃশ্য!
সাদা-কালো শহর, যেখানে মানুষের ছায়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু তারা সবাই ধোঁয়ার মতো, যেন ভূতের দল!
এক ভয়ঙ্কর সত্যের প্রকাশ
একটা কামরায় ঢুকতেই তারা দেখল, সেখানে একটা পুরনো চেয়ার।
আর সেখানে বসে আছে সেই বৃদ্ধা!
“তোমরা ফিরে এসেছো… এবার সত্যি জানতে পারবে!”
অর্ণব গলা শুকিয়ে বলল, “এই ট্রেন কী? তুমি কে?”
বৃদ্ধা ধীরে ধীরে বলল,
“এটি মৃতদের ট্রেন। এখানে শুধু তারাই আসে, যারা সত্যের খোঁজ করে।”
অর্ণবের বাবার রহস্য
তানিয়া জিজ্ঞেস করল, “তাহলে অর্ণবের বাবা কী সত্যি খুন হয়েছেন?”
বৃদ্ধা এক শ্বাসে বলল,
“না। সে খুন হয়নি। সে এই ট্রেনের অংশ হয়ে গিয়েছে!”
অর্ণব চমকে উঠল, “মানে?”
বৃদ্ধা ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে ট্রেনের এক পাশে দেখাল।
একটা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক পুরুষ, যাকে অর্ণব চিনতে পারল।
এটা তো তার বাবার ছবি! কিন্তু… তিনি কি সত্যিই এখানে?”
সত্যের শেষ সিদ্ধান্ত
বৃদ্ধা ফিসফিস করে বলল,
“তুমি যদি চাও, তবে এখানেই থেকে যেতে পারো, তোমার বাবাকে খুঁজে বের করতে পারো। কিন্তু একবার থেকে গেলে আর ফিরে যেতে পারবে না!”
অর্ণব আর তানিয়া একে অপরের দিকে তাকাল।
তানিয়া বলল, “তুমি কী করবে, অর্ণব?”
অর্ণব ধীরে ধীরে জানালার দিকে এগিয়ে গেল।
বাইরে এক রহস্যময় জগৎ, যেখানে মৃতদের ছায়ারা ঘুরে বেড়াচ্ছে।
তার বাবা কি সত্যিই সেখানে? নাকি এটা শুধু এক মরীচিকা?
শেষ সিদ্ধান্ত নিতে হবে! অর্ণব কি ট্রেনে থেকে যাবে, নাকি ফিরে যাবে?
অর্ণব ধীরে ধীরে জানালার দিকে এগিয়ে গেল।
সেখানে এক ছায়াময় অবয়ব দাঁড়িয়ে আছে।
সে কি সত্যিই তার বাবা? নাকি শুধুই এক বিভ্রম?
তানিয়া পেছন থেকে বলল, “অর্ণব, তুমি কি নিশ্চিত? একবার থেকে গেলে আর ফিরে যেতে পারবে না!”
অর্ণব নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকাল।
“আমি সত্য জানতে চাই। যদি আমার বাবা এখানে থেকে গিয়ে থাকেন, আমি তাকে একা ছাড়তে পারি না।”
তানিয়া হতবাক হয়ে গেল।
সত্যের শেষ পদক্ষেপ
বৃদ্ধা মৃদু হেসে বলল,
“তাহলে এই ট্রেনই হবে তোমার নতুন ঘর।”
তারপর ট্রেন প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেল!
চারপাশের দৃশ্য বদলে গেল।
তানিয়া আর কোনো কথা বলতে পারল না, হঠাৎ করেই সে ট্রেন থেকে ছিটকে পড়ল!
সে দেখল, ট্রেন দূরে চলে যাচ্ছে।
অর্ণব তার দিকে তাকিয়ে বলল, “তানিয়া, ফিরে যাও। আমার গল্প এখানে শেষ নয়!”
হারিয়ে যাওয়া ট্রেন
গুপ্তসাগর এক্সপ্রেস এক অন্ধকার জগতে হারিয়ে গেল।
কেউ জানে না, এরপর কী হলো।
তানিয়া শুধু জানে, সেই রাতের পর অর্ণব আর কখনও ফিরে আসেনি।
স্টেশনের কিংবদন্তি
বছর কেটে গেছে।
আজও পুরুলিয়া স্টেশনের শেষ প্ল্যাটফর্মে কেউ কেউ শপথ করে বলে—
রাত বারোটায় তারা এক অদ্ভুত ট্রেন দেখতে পায়, যেখানে জানালার ধোঁয়াশার মধ্যে এক তরুণকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
সে কি অর্ণব? নাকি ট্রেনের নতুন আত্মা?
কেউ জানে না।
কিন্তু একটাই কথা শোনা যায়—
“গুপ্তসাগর এক্সপ্রেসে যারা একবার ওঠে, তারা আর ফিরে আসে না!”
পুরুলিয়া স্টেশন, এক বছর পর…
রাত তখন ১১:৫৫।
স্টেশনের শেষ প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে একজন যুবক, নাম বিক্রম।
সে শুনেছে একটা কিংবদন্তি—এক বছর আগে এক তরুণ ট্রেনে উঠে আর ফিরে আসেনি।
আর আজও মাঝেমধ্যে দেখা যায় সেই ট্রেনকে, যেখানে এক যুবক জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।
কিন্তু বিক্রম এই গল্প বিশ্বাস করে না।
সে সত্য জানতে চায়।
ট্রেন ফিরে এল!
ঠিক বারোটার সময় হঠাৎ করেই বাতাস বদলে গেল।
স্টেশনের লাইটগুলো ফ্লিকার করতে লাগল।
একটা গভীর হুইসেল শোনা গেল, কিন্তু আশেপাশে কোনো ট্রেন নেই!
তারপরই ঘন কুয়াশার মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে একটা ট্রেন এসে দাঁড়াল।
গুপ্তসাগর এক্সপ্রেস!
অতীতের ছায়া
বিক্রম ভয় না পেয়ে ধীরে ধীরে ট্রেনের কাছে গেল।
দরজা আপনা-আপনি খুলে গেল, আর ভিতর থেকে এক গা ছমছমে বাতাস বেরিয়ে এলো।
সে পা বাড়াতেই পেছন থেকে কেউ চিৎকার করে বলল, “বিক্রম! থামো!”
সে ঘুরে দেখল, তানিয়া ছুটে আসছে।
পুরোনো সাক্ষী, নতুন রহস্য
তানিয়া হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “বিক্রম, এটা কোনো সাধারণ ট্রেন নয়! আমি এক বছর আগে এক বন্ধুকে হারিয়েছি!”
বিক্রম মুচকি হেসে বলল, “তাই তো আমি এসেছি। আমি জানতে চাই, সে কোথায় গেছে?”
তানিয়া আতঙ্কিত হয়ে বলল, “তুমি বুঝতে পারছো না! যদি তুমি ওঠো, তাহলে…”
কিন্তু তার কথা শেষ হওয়ার আগেই বিক্রম ট্রেনে উঠে পড়ল!
দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
নতুন যাত্রা, নতুন আতঙ্ক
ভিতরে ঢুকতেই বিক্রম দেখল, কামরাগুলো অদ্ভুত রকমের নিঃশব্দ।
কিন্তু হঠাৎ করে সামনের সিটে কেউ বসে আছে বলে মনে হলো।
সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল, আর দেখতে পেল…
কেউ একজন জানালার দিকে তাকিয়ে আছে।
বিক্রম হাত বাড়িয়ে বলল, “আপনি কে?”
ব্যক্তিটি ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল।
তার চেহারা বিক্রমের খুব চেনা লাগল!
অর্ণব ফিরে এল?
বিক্রম বিস্ময়ে ফিসফিস করে বলল, “তুমি… তুমি কি অর্ণব?”
সেই ব্যক্তি মৃদু হেসে বলল, “তুমি এখানে কেন এসেছো?”
বিক্রম বলল, “আমি সত্য জানতে চাই! এই ট্রেন কোথায় যায়? কেন কেউ ফিরে আসে না?”
অর্ণব ধীরে ধীরে বলল,
“তুমি জানো না, কিন্তু এই ট্রেনের গল্প এখনও শেষ হয়নি। আসল রহস্য লুকিয়ে আছে শেষ কামরায়!”
শেষ কামরার দরজা
বিক্রম আর অর্ণব ধীরে ধীরে ট্রেনের শেষ কামরার দিকে এগোল।
দরজার সামনে এসে অর্ণব থেমে গেল।
“তুমি কি নিশ্চিত, বিক্রম? এই দরজা একবার খুললে আর ফিরে যাওয়া যাবে না!”
বিক্রম গলা শক্ত করে বলল, “আমি প্রস্তুত!”
অর্ণব ধীরে ধীরে দরজার হাতল ধরল…
আর তখনই ট্রেন ভয়ঙ্কর ঝাঁকুনি খেল!
চারপাশের বাতাস কেঁপে উঠল, আর দরজা আপনা-আপনি খুলে গেল…
দরজা খুলতেই বিক্রম আর অর্ণব দেখল, ভিতরে ঘন অন্ধকার।
কিন্তু হঠাৎ একটা ঠান্ডা বাতাস তাদের মুখে লাগল, যেন কামরার মধ্যে অন্য কোনো জগৎ লুকিয়ে আছে!
অর্ণব ফিসফিস করে বলল, “এই কামরায় ঢোকার পর কেউ আর ফিরে আসেনি।”
বিক্রম দ্বিধা না করে পা বাড়াল।
ভুতুড়ে যাত্রীদের জগৎ
ভিতরে ঢুকতেই তারা দেখতে পেল, কামরার ভেতর সারি সারি সাদা পোশাক পরা মানুষ বসে আছে!
কেউ কথা বলছে না, শুধু শূন্য দৃষ্টিতে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে।
সবাই মৃত?
বিক্রম ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে একটা ব্যক্তির সামনে গিয়ে বলল, “আপনি কে?”
ব্যক্তিটি ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল।
তার চোখ দুটি পুরো কালো!
তার গলা থেকে কেবল ফিসফিস শব্দ বের হলো,
“আমরা সেই যাত্রীরা, যারা ভুল করে এই ট্রেনে উঠেছি। আর এখন আর ফিরতে পারি না।”
গুপ্তসাগর এক্সপ্রেসের রহস্য ফাঁস!
বিক্রম হাড়-শীতল গলায় বলল, “কিন্তু এই ট্রেন কোথায় যাচ্ছে?”
এক বৃদ্ধ লোক হঠাৎ বলে উঠল,
“এই ট্রেন শুধু মৃতদের জন্য। যারা জীবিত, তারা এখানে বেশিক্ষণ থাকলে… তাদেরও আর ফেরা হবে না!”
বিক্রমের দুঃস্বপ্ন!
হঠাৎ কামরার দরজা প্রচণ্ড আওয়াজ করে বন্ধ হয়ে গেল!
চারপাশে বাতাস ঘুরতে লাগল, আর সেই সাদা পোশাকের যাত্রীরা আস্তে আস্তে বিক্রম আর অর্ণবের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল!
তাদের মুখের চামড়া খুলে যাচ্ছে, আর নিচে থেকে বের হচ্ছে… কঙ্কালের মতো ভয়ঙ্কর চেহারা!
বিক্রম চিৎকার করে উঠল, “অর্ণব, দৌড়াও!”
বেঁচে ফেরার পথ
অর্ণব আর বিক্রম দরজার দিকে দৌড় দিল।
কিন্তু দরজা বন্ধ!
পেছন থেকে সেই আত্মারা হাত বাড়িয়ে বলল,
“তোমরা চলে যেতে পারবে না… এবার তোমরাও আমাদের মতো হয়ে যাবে!”
গুপ্ত বৃদ্ধার রহস্যময় সাহায্য
ঠিক তখনই হঠাৎ কামরার এক পাশে সেই বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে পড়ল, যে আগেও অর্ণবকে সতর্ক করেছিল!
সে বলল, “তোমাদের একটা সুযোগ আছে! ট্রেন যখন টানেলের মধ্যে ঢুকবে, তখন লাফ দাও!”
মরণ-জীবনের লাফ
বিক্রম আর অর্ণব একে অপরের দিকে তাকাল।
তাদের সামনে খুব বেশি সময় নেই!
ট্রেন দ্রুতগতিতে একটা টানেলের দিকে এগোচ্ছে।
আর তারা জানে, যদি এবার না লাফায়, তাহলে চিরদিনের জন্য এই ট্রেনের অংশ হয়ে যাবে!
বিক্রম আর অর্ণব কি ট্রেন থেকে পালাতে পারবে? নাকি তারাও চিরকালের জন্য হারিয়ে যাবে?
ট্রেন প্রবল গতিতে টানেলের দিকে এগিয়ে চলেছে।
বিক্রম আর অর্ণব দরজার কাছে দাঁড়িয়ে, মুখে আতঙ্কের ছাপ।
শেষ সুযোগ!
বৃদ্ধা বলল, “এটাই শেষ সুযোগ! যদি লাফ না দাও, তাহলে তোমরা আর কখনো ফিরে যেতে পারবে না!”
বিক্রম মুষ্টিবদ্ধ হাতে দরজার লোহার রেলিং ধরল।
অর্ণব ধীরে ধীরে বলল, “আমি জানি না, আমার ফেরা উচিত কি না…”
বিক্রম চমকে উঠল, “তুমি কী বলছো?! আমাদের যেতে হবে!”
অর্ণবের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত
অর্ণব গভীর শ্বাস নিল।
তার চোখে এক অদ্ভুত স্থিরতা।
“আমি এখানেই থাকবো, বিক্রম। এই ট্রেনের রহস্য আমি এখন বুঝেছি। এটা শুধু মৃতদের ট্রেন নয়, এটা এক শাস্তি!”
বিক্রম হতভম্ব হয়ে গেল, “মানে?”
অর্ণব ফিসফিস করে বলল,
“যারা একবার এই ট্রেনে উঠে পড়ে, তারা হয়তো সত্যিই মরে না… কিন্তু তারা হারিয়ে যায়, সময়ের বাইরে, এক অনন্ত যাত্রায়।”
শেষ বিদায়
বিক্রম চিৎকার করে বলল, “না! তুমি আসছো!”
কিন্তু তখনই দরজাগুলো শক্তভাবে বন্ধ হয়ে গেল!
ট্রেন প্রবল ঝাঁকুনি খেল, আর জানালার বাইরে অন্ধকার ঘনিয়ে এলো।
বৃদ্ধা নিঃশব্দে বলল, “এখন আর কোনো পথ নেই।”
বিক্রম জানত, এবার সব শেষ।
তার চারপাশে সাদা পোশাকের আত্মারা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে।
চিরকালের যাত্রী
ট্রেনের বাইরে থেকে কেউ কোনোদিন দেখতে পেল না অর্ণব বা বিক্রমকে।
তারা আর কখনো ফিরে এলো না।
আর সেই রাতের পর থেকে—
পুরুলিয়া স্টেশনের কিছু মানুষ মাঝেমধ্যে গুপ্তসাগর এক্সপ্রেসের জানালায় দুটো ছায়া দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।
তারা এক অদ্ভুত গলায় ফিসফিস করে বলে,
“তুমিও একদিন এই ট্রেনে উঠবে…”