রাত তখন প্রায় তিনটা। বাইক ছুটছিল শহরের ফাঁকা রাস্তায়। বাতাসের শীতল স্পর্শেও সুদীপ্তার কপালে ঘাম জমছিল।
অনিরুদ্ধ রিয়ারভিউ মিররে এক ঝলক দেখল— পিছনে কেউ আসছে না। আপাতত তারা নিরাপদ।
— “আমরা কোথায় যাচ্ছি?” সুদীপ্তা চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল।
— “এখন নিরাপদ জায়গা খুঁজতে হবে। আমাদের খুঁজে বের করাটা ওদের জন্য বেশি কঠিন করা দরকার।”
বাইক শহরের মূল রাস্তা ছেড়ে সরু গলির দিকে মোড় নিল। অনিরুদ্ধ এমন একটা জায়গায় যাচ্ছিল, যেখানে খুব কম লোকই যায়।
সুদীপ্তা চারপাশে তাকাল। রাস্তার লাইটগুলো জ্বলছে, কিন্তু আশেপাশে কোনো মানুষ নেই। শুধু কিছু ভবঘুরে কুকুর রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।
— “অনিরুদ্ধ, তুমি কি আগে থেকেই জানতে, ওরা আমাদের পিছু নেবে?”
অনিরুদ্ধ গভীর একটা নিশ্বাস ফেলল।
— “আমি জানতাম না, কিন্তু একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল। যেদিন থেকে আমি ওদের সম্পর্কে খোঁজ নিতে শুরু করেছি, সেদিন থেকেই মনে হচ্ছিল, কেউ আমার গতিবিধি লক্ষ্য করছে।”
— “তাহলে আমরা আসলে কাদের হাত থেকে পালাচ্ছি?”
অনিরুদ্ধ বাইক থামিয়ে দিল।
সামনে একটা পরিত্যক্ত বাড়ি। জানালার কাঁচ ভাঙা, দরজাটা আধা খোলা। দেয়ালগুলোতে পুরনো পোস্টার আর ময়লা জমে আছে।
— “এখানে রাতটা কাটাব। ওরা যদি আমাদের খুঁজে বের করতেও চায়, এত সহজে পারবে না।”
সুদীপ্তার চোখে ভয়।
— “তুমি নিশ্চিত এখানে নিরাপদ?”
— “এখন নিরাপদ জায়গার সংজ্ঞা পাল্টে গেছে, সুদীপ্তা। আমাদের কাছে আর কোনো বিকল্প নেই।”
ওরা আস্তে করে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল।
কিন্তু ওরা জানত না, এই পরিত্যক্ত বাড়ির মধ্যেই অপেক্ষা করছিল নতুন এক রহস্য…
পরিত্যক্ত বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই একটা গন্ধ নাকে এল— পুরনো কাঠের গন্ধ, আর একটু পচা স্যাঁতসেঁতে ভাব।
সুদীপ্তা হাত দিয়ে নাক ঢাকল। “এটা কী জায়গা?”
অনিরুদ্ধ ফিসফিস করে বলল, “শান্ত থেকো। অন্ধকারে চোখ সয়ে গেলে বুঝতে পারবে।”
সুদীপ্তা ধীরে ধীরে চারপাশের আবছা অবয়ব বুঝতে পারল। চারপাশে ধুলো জমে আছে, দেওয়ালে ছেঁড়া কাগজ লেগে রয়েছে, মেঝেতে শুকনো পাতা আর বোতল পড়ে আছে।
হঠাৎ কিছুর নড়ার শব্দ শোনা গেল!
সুদীপ্তা আঁতকে উঠল, “ওটা কী?”
অনিরুদ্ধ সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে একটা ছোট টর্চ বের করল। আলো ফেলতেই সামনের কর্নারে একটা কাঠের চেয়ার দেখা গেল।
কিন্তু সেটা খালি ছিল না!
একটা লোক বসে আছে।
পুরো শরীর ধুলোয় ঢাকা, চোখ বন্ধ, মাথাটা এক পাশে হেলে আছে।
সুদীপ্তা আতঙ্কে অনিরুদ্ধের হাত চেপে ধরল, “ও বেঁচে আছে?”
অনিরুদ্ধ ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে গেল। সে ভালো করে লক্ষ্য করল— লোকটা নিঃশ্বাস নিচ্ছে না!
তার গলা কাটা!
কিন্তু তখনই…
চেয়ারের পিছনের দেওয়ালে একটা শব্দ হলো, যেন কেউ নখ দিয়ে আঁচড় কাটছে!
সুদীপ্তা ভয়ে অনিরুদ্ধের পেছনে সরে গেল।
অন্ধকারের মধ্যে থেকে আস্তে আস্তে একটা ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এল।
একটা কণ্ঠস্বর ফিসফিস করে বলল—
“তোমরা যেটা খুঁজছ, তার উত্তর এখানে নেই… কিন্তু এর থেকে বেরোনোর পথও নেই!”
সুদীপ্তার গলা শুকিয়ে গেল। অনিরুদ্ধ টর্চের আলোটা সরিয়ে ছায়ামূর্তির দিকে ধরতেই সেটা এক মুহূর্তের জন্য দৃশ্যমান হলো—
একটা বয়স্ক মানুষ, পাতলা গড়ন, দাড়ি ঝুলে পড়েছে, চোখদুটো গভীর আর উদ্ভ্রান্ত!
লোকটা একপা এগিয়ে এল।
— “তোমরা এখানে কেন এসেছ?”
অনিরুদ্ধ সাবধানী গলায় বলল, “আমরা শুধু এক রাতের আশ্রয় খুঁজছি।”
লোকটা একটা রহস্যময় হাসি দিল।
— “আশ্রয়? এই শহরে কেউই নিরাপদ না। তোমরা যা দেখেছ, সেটা কেবল শুরু। তোমরা যদি এখান থেকে বেরোতে চাও, তাহলে একটাই পথ আছে…”
সুদীপ্তা আতঙ্কিত গলায় বলল, “কী পথ?”
লোকটা ধীরে ধীরে সামনে এল, ফিসফিস করে বলল—
“সবকিছু ভুলে যাও… নাহলে তোমাদের আর সকাল দেখার সুযোগ মিলবে না!”
অনিরুদ্ধ আর এক মুহূর্ত দেরি করল না।
— “চলো, সুদীপ্তা! আমরা এখানে থাকব না!”
লোকটা তখনও হাসছিল, যেন সে জানত তারা এখান থেকে বেরোতে পারবে না।
বাইরে তখনো অন্ধকার। কিন্তু সুদীপ্তা আর অনিরুদ্ধ জানত—
এই অন্ধকার কেবল রাতের নয়, এই সমাজের অনেক গভীর সত্য লুকিয়ে আছে এর ছায়ায়…
সুদীপ্তার শরীরে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল।
লোকটার চোখদুটো স্থির, তীক্ষ্ণ— যেন সে শুধু কথা বলছে না, তাদের অন্তরের ভীতিটা টেনে বের করছে!
অনিরুদ্ধ তার হাত চেপে ধরল। “এখান থেকে বেরোতে হবে। এখনই!”
লোকটা তখনও হাসছিল।
— “তোমরা বেরোতে পারবে না। শহরের রাস্তাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে।”
সুদীপ্তা বিস্ময়ে তাকাল। “তুমি কী বলতে চাও?”
লোকটা আস্তে আস্তে পিছিয়ে গেল, দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে বলল—
“তোমরা যদি সত্যি পালাতে চাও, তাহলে সেই নামটা জানতে হবে।”
— “কোন নাম?”
লোকটা এবার কাঁপা কাঁপা গলায় ফিসফিস করে বলল—
“যে নাম মুখে আনলেই মানুষ হারিয়ে যায়…”
“অভিশপ্ত সমাজের সেই নাম—”
ঠিক তখনই বাইরে পুলিশের সাইরেন বেজে উঠল!
অনিরুদ্ধ দ্রুত জানালার দিকে তাকাল। দূরে কয়েকটা গাড়ির আলো দেখা যাচ্ছে, রাস্তায় কাঁচ ভাঙার শব্দ!
সুদীপ্তা কাঁপতে কাঁপতে বলল, “ওরা আমাদের জন্যই এসেছে?”
লোকটা এবার পুরোপুরি ছায়ায় মিশে গেল।
শেষবারের মতো তার কণ্ঠস্বর শোনা গেল—
“তোমাদের সময় ফুরিয়ে আসছে…”
পুলিশের সাইরেনের শব্দ ধীরে ধীরে আরও কাছে আসছিল।
অনিরুদ্ধ দ্রুত জানালার দিকে এগোল। রাস্তার ধুলো উড়িয়ে পুলিশের গাড়িগুলো এসে থামল পরিত্যক্ত বাড়ির সামনেই। কয়েকজন অফিসার গাড়ি থেকে নামল, টর্চের আলো ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে।
— “তারা কীভাবে জানল আমরা এখানে?” সুদীপ্তার কণ্ঠে আতঙ্ক।
অনিরুদ্ধ চিন্তিত গলায় বলল, “কেউ হয়তো আমাদের উপস্থিতির খবর দিয়েছে… কিন্তু কে?”
ঠিক তখনই সেই অদ্ভুত লোকটির কথা মনে পড়ল।
“তোমাদের সময় ফুরিয়ে আসছে…”
— “ও কি আমাদের ফাঁদে ফেলল?” সুদীপ্তা ফিসফিস করল।
অনিরুদ্ধ হাত দিয়ে তাকে চুপ করতে ইঙ্গিত দিল।
বাইরে অফিসাররা কথা বলছিল।
— “বাড়ির ভেতরে কেউ লুকিয়ে থাকতে পারে। ভালো করে তল্লাশি চালাও!”
সুদীপ্তার শ্বাসরোধ হয়ে আসছিল। পুলিশ এলে তো স্বাভাবিকভাবে ভয় পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল না।
অনিরুদ্ধ দ্রুত চারপাশে তাকিয়ে পালানোর পথ খুঁজল। পেছনের জানালাটা খানিকটা খোলা ছিল।
— “ওটা দিয়ে বেরোতে হবে!” অনিরুদ্ধ কানে কানে বলল।
সুদীপ্তা ধীরে ধীরে জানালার দিকে এগোল, কিন্তু ঠিক তখনই…
ঘরের ভেতরে একটা ভারী আওয়াজ হল!
পুলিশের টর্চের আলো জানালা দিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ল।
— “সাউন্ড এলো ভেতর থেকে! দরজা ভেঙে ঢুকতে হবে!”
পুলিশের পা দাপানোর শব্দ এগিয়ে আসছে।
অনিরুদ্ধ আর এক মুহূর্তও দেরি করল না। সে সুদীপ্তার হাত ধরে জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ল!
বাইরে ঠান্ডা বাতাস বইছিল।
পিছনে পুলিশের চিৎকার—
— “ওরা পালাচ্ছে! ধরো!”
অনিরুদ্ধ আর সুদীপ্তা ছুটতে শুরু করল।
সামনের রাস্তা অন্ধকার, কিন্তু ওরা জানত, এই শহরের অন্ধকারের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আরও ভয়ংকর কিছু…
অনিরুদ্ধ আর সুদীপ্তা ছুটতে শুরু করল। চারদিক নিস্তব্ধ, শুধু তাদের দৌড়ানোর শব্দ বাতাস কেটে এগিয়ে চলছিল। রাস্তার দু’পাশের গাছগুলো কালো ছায়ার মতো ঠায় দাঁড়িয়ে, যেন তাদের নিরবে অনুসরণ করছে।
পেছনে তাকানোর সাহস কারও নেই, কিন্তু অনুভব করতে পারছিল তারা—কেউ যেন তাদের পেছন পেছন আসছে!
সুদীপ্তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছিল, অনিরুদ্ধ তার হাত শক্ত করে ধরে বলল, “সামনে ওই গলিটা… দ্রুত ঢুকে পড়তে হবে!”
গলির মুখে পৌঁছানোর আগেই পেছন থেকে ভেসে এল একটা থমথমে গম্ভীর স্বর—
“থেমে যাও!”
হঠাৎ, যেন পুরো পরিবেশ থমকে গেল। অনিরুদ্ধ আর সুদীপ্তা দৌড়ানোর মধ্যেই শরীর জমে গেল।
সুদীপ্তা চোখ বন্ধ করে ফিসফিস করে বলল, “ওরা আমাদের দেখে ফেলেছে…”
অনিরুদ্ধ আর সুদীপ্তা ছুটতে থাকলো। রাতের অন্ধকারে তাদের ছায়াগুলো দ্রুত দৌড়াচ্ছে, যেন ভয় আর উৎকণ্ঠার প্রতিচ্ছবি হয়ে গেছে। রাস্তার বাতিগুলোও মাঝে মাঝে জ্বলে আর নিভে, পরিবেশটাকে আরও ভৌতিক করে তুলছে।
পেছনে কারো ভারী বুটের শব্দ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। কে বা কারা তাদের অনুসরণ করছে, সেটা বুঝতে না পারলেও একটা ব্যাপার পরিষ্কার—এটা নিছক কাকতালীয় কিছু নয়!
“আরও জোরে দৌড়াও, সুদীপ্তা!” অনিরুদ্ধ ফিসফিস করে বলল।
সুদীপ্তা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “আমি পারছি না… আমার পা যেন কাজ করছে না!”
“তুমি পারবে! ওই গলিটার ভিতরে ঢুকতে পারলে আমরা হয়তো বাঁচতে পারব!” অনিরুদ্ধ তার হাত শক্ত করে ধরে টেনে নিল সামনে।
হঠাৎ!
পিছন থেকে একটা তীক্ষ্ণ শব্দ ভেসে এল—
“থেমে যাও!”
সুদীপ্তার হৃদস্পন্দন যেন থমকে গেল। শরীর কাঁপতে শুরু করল ভয়ে। অনিরুদ্ধও মুহূর্তের জন্য থমকে গিয়েছিল, কিন্তু পরক্ষণেই শক্ত হয়ে বলল, “চলো, থামলে আমরা শেষ!”
ঠিক তখনই, পাশের পরিত্যক্ত বাড়িটার ছাদ থেকে কারো ছায়ামূর্তি নেমে এলো!
এক ঝটকায় কেউ একজন অনিরুদ্ধের কলার চেপে ধরল, অন্যদিকে সুদীপ্তার মুখ চেপে ধরল আরও একটা হাত!
গলির ভিতর ভেসে এল সুদীপ্তার অস্পষ্ট চিৎকার—
“উমমম… ছেড়ে দাও!”
অনিরুদ্ধ আর সুদীপ্তা নিজেদের ছাড়ানোর চেষ্টা করতে থাকলেও, শক্তিশালী হাতগুলো তাদের আঁকড়ে ধরে রাখল। গভীর অন্ধকারের মধ্যে থেকে একটা কর্কশ গলা শোনা গেল—
“একদম চুপ! বেশি নড়াচড়া করলে এখানেই শেষ করে দেব!”
অনিরুদ্ধ আতঙ্কিত হলেও নিজেকে সামলে বলল, “আমাদের কেন ধরেছো? আমরা তো কিছু করিনি!”
কিন্তু উত্তর এল না।
দুই মুখোশধারী লোক তাদের গলির আরও গভীরে টেনে নিয়ে গেল। জায়গাটা এতটাই অন্ধকার যে, সামনের কয়েক ফুট দূরের জিনিসও বোঝা যাচ্ছে না। হঠাৎ করে, একটা বিশাল লোহার দরজা খুলে গেল, আর সঙ্গে সঙ্গে কড় কড় করে তালা লাগানোর শব্দ শোনা গেল।
সুদীপ্তা শ্বাস নিতে পারছিল না। ও ফিসফিস করে বলল, “আমাদের কোথায় নিয়ে এলো?”
ঠিক তখনই, একটা হালকা হলুদ আলো জ্বলে উঠল। সামনে দাঁড়িয়ে আছে একজন মধ্যবয়স্ক লোক, যার চোখের দৃষ্টি ভয়ঙ্করভাবে চেপে বসছে অনিরুদ্ধ আর সুদীপ্তার গায়ে।
লোকটা ধীর গলায় বলল, “তোমরা যা দেখে ফেলেছো, সেটা বাইরের কেউ জানতে পারবে না।”
সুদীপ্তা কাঁপতে কাঁপতে বলল, “আমরা… আমরা কিছুই দেখিনি! বিশ্বাস করুন!”
লোকটা ঠান্ডা গলায় হেসে উঠল। “তা তো বলবেই। কিন্তু বিশ্বাস করলেই তো হবে না, প্রমাণও লুকাতে হয়।”
অনিরুদ্ধ বুঝতে পারল, তারা ভয়ানক কোনো ফাঁদের মধ্যে আটকে গেছে। কিন্তু এখান থেকে বেরোনোর পথ কি আদৌ আছে?
রহস্যময় সমাজ – পর্ব ৩ : অদৃশ্য শত্রু – শীঘ্রই…