রাত তখন গভীর, আকাশে কালো মেঘ জমেছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে মাঝে মাঝে, আর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। নির্জন এই গ্রামটি বহুদিন ধরেই অন্ধকার এক রহস্যের আড়ালে ঢাকা। এই গ্রামের শেষ সীমানায় রয়েছে এক পুরনো বাড়ি, নাম ‘নীলকুঠি’। কেউ বলে, এখানে একসময় জমিদার থাকত, আবার কেউ বলে, ওটা এক অভিশপ্ত আত্মার আস্তানা। সন্ধ্যার পর কেউই ওই বাড়ির আশেপাশে ঘেঁষে না।
তবে শহর থেকে আসা তরুণ গবেষক সায়ন এসব কুসংস্কারে বিশ্বাস করে না। সে লোককথা ও ভৌতিক ঘটনার সত্যতা খুঁজতে গ্রামে এসেছে। গ্রামবাসীদের হাজার বারণ সত্ত্বেও, সে এক রাত ওই বাড়িতে কাটানোর সিদ্ধান্ত নেয়। তার সঙ্গে ক্যামেরা, টর্চ, আর কিছু যন্ত্রপাতি—সব প্রস্তুত।
ভবনের অভ্যন্তরে প্রবেশ
নীলকুঠির বিশাল লোহার দরজাটা ঠেলে ঢুকতেই এক অদ্ভুত স্যাঁতসেঁতে গন্ধ এসে লাগল নাকে। চারদিকে ধুলো জমে আছে, মাকড়সার জাল ঝুলছে দেওয়ালে। মেঝের কাঠগুলোও যেন ভাঙা ও শক্তিহীন। হঠাৎ করেই যেন ঘরটায় ঠান্ডা শীতল বাতাস বয়ে গেল, গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল সায়নের।
সায়ন তার ক্যামেরাটা অন করল। কিন্তু অবাক ব্যাপার! ক্যামেরায় সব ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। মোবাইলও কাজ করছে না!
“কী আজব ব্যাপার!”—সে ফিসফিস করে বলল।
ঘরের এক কোণায় একটা পুরনো দড়ি ঝুলছে, যা দেখেই মনে হচ্ছে, কেউ যেন এখানে আত্মহত্যা করেছিল। মেঝেতে শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ স্পষ্ট! সায়ন এগিয়ে গিয়ে ভালো করে দেখতে গেল।
হঠাৎ— পিছন থেকে কেউ তার কাঁধে ঠাণ্ডা হাত রাখল!
সে দ্রুত ঘুরে তাকাল, কিন্তু সেখানে কেউ নেই। মাথার চুল খাড়া হয়ে গেল তার। মনে হচ্ছিল, বাড়িটা যেন ধীরে ধীরে তাকে গ্রাস করতে চাইছে।
নতুন রহস্য: অতৃপ্ত আত্মা
সায়ন যখন একটু সামলে নিল, তখন তার নজরে এলো দেয়ালে আঁকা কিছু রহস্যময় প্রতীক। প্রতীকগুলোর মধ্যে কিছু হিন্দু তন্ত্রমন্ত্রের চিহ্ন ছিল। সে মোবাইলের আলো ফেলে পরীক্ষা করছিল, এমন সময় পেছন থেকে এক বিকট আওয়াজ এলো—
“তুই কে? কেন এলি?”
সায়ন আতঙ্কে দ্রুত পিছিয়ে গেল। তার সামনে দেখা দিল এক অর্ধস্বচ্ছ ছায়ামূর্তি। তার শরীরে ক্ষতচিহ্ন, চোখ জ্বলজ্বল করছে।
সায়ন সাহস করে বলল, “তুমি কে?”
সেই ছায়া ধীরে ধীরে সায়নের দিকে এগিয়ে এল এবং বলল, “আমি কিশোরী। একসময় এই বাড়ির দাসী ছিলাম। কিন্তু জমিদারের নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে আমি এখানে মরে গেছি। আমার আত্মা মুক্তি চায়!”
গভীর রাতে আতঙ্ক
রাত বাড়তে থাকল। বাইরে বৃষ্টি থেমে গেছে, কিন্তু হাওয়া বইছে জোরে। হঠাৎ করেই বাড়ির দোতলায় জোরে কারও পায়ের আওয়াজ শোনা গেল। সায়ন ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগল। প্রতিটি ধাপেই যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি তাকে আটকে দিতে চাইছে।
উপরের ঘরটা একসময় হয়তো কারও শয়নকক্ষ ছিল, কিন্তু এখন ধ্বংসপ্রাপ্ত। জানালা দিয়ে আসা জ্যোৎস্নার আলোয় হালকা কিছু ছায়া নড়াচড়া করছে।
“হ্যালো? কেউ আছেন?”—সায়ন জিজ্ঞাসা করল।
কিন্তু জবাব এল অন্য দিক থেকে—
“তুমি চলে যাও… এখান থেকে…”
সায়নের বুক কেঁপে উঠল। এই কণ্ঠস্বরটা কোথা থেকে এল? সে দ্রুত ক্যামেরার দিকে তাকাল, কিন্তু সেখানে কেবল অন্ধকার। ঘরের এক কোণে তাকাতেই দেখল, একটা কালো ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে! মুখ দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু চোখ দুটো লাল জ্বলজ্বল করছে।
এতক্ষণ পর্যন্ত সাহস ধরে রাখা সায়ন আর সহ্য করতে পারল না। সে দৌড়ে নিচে নামতে শুরু করল, কিন্তু পা পিছলে পড়ে গেল মেঝেতে। কানে আসছে কারও চাপা হাসির শব্দ।
অভিশপ্ত ইতিহাস
সায়ন মেঝেতে পড়েই অনুভব করল, যেন অদৃশ্য কিছু একটা তাকে চেপে ধরে আছে। সে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। ঠিক তখনই তার চোখ পড়ল ঘরের কোণে রাখা একটা পুরনো চিঠির দিকে।
চিঠিতে লেখা ছিল:
“যদি কেউ এই বাড়িতে আসে, তবে সে আর ফিরে যাবে না। আমি ছিলাম এই বাড়ির শেষ বাসিন্দা, কিন্তু জমিদারের অভিশাপে আমি বন্দী হয়ে গেছি। যদি মুক্তি চাও, তাহলে মধ্যরাতের আগে এখান থেকে পালাও!”
সায়নের শরীর ঘামতে লাগল। সে দ্রুত উঠে দাঁড়াল, কিন্তু দরজা বন্ধ! জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল, বাড়ির চারপাশে কালো ছায়ারা ঘুরে বেড়াচ্ছে।
কিশোরীর আত্মা ও মুক্তির উপায়
ঠিক তখনই কিশোরীর আত্মা আবার দেখা দিল। সে বলল, “তুমি চাইলে আমাকে মুক্ত করতে পারো। নাহলে তোমারও পরিণতি আমার মতোই হবে।”
সায়ন ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “কিন্তু আমি কীভাবে তোমাকে মুক্ত করব?”
কিশোরী বলল, “বাড়ির নিচে জমিদারের গুপ্তঘর আছে। সেখানে আমার হাড়গোড় রাখা হয়েছে। ওগুলো বাইরে এনে নদীতে ভাসিয়ে দিলে আমি মুক্ত হবো।”
সায়ন দ্রুত নেমে এল। অনেক খোঁজাখুঁজি করে সে গুপ্তঘর খুঁজে পেল। সেখানে সত্যিই কিছু পুরনো হাড়গোড় ছিল! সে দ্রুত সেগুলো একটি কাপড়ে বেঁধে বাড়ির বাইরে নিয়ে এল।
ঠিক যখনই সে নদীর ধারে পৌঁছাল, তখনই পেছন থেকে এক বিকট চিৎকার শোনা গেল। পুরো আকাশ বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।
সায়ন দেরি না করে হাড়গোড় নদীতে ফেলে দিল। সাথে সাথে পুরো বাড়ি কেঁপে উঠল, আর এক মুহূর্ত পর সব শান্ত হয়ে গেল।
সায়ন ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ল। তার মনে হলো, কিশোরীর আত্মা মুক্তি পেয়েছে।
পরদিন সকালে, গ্রামের লোকেরা এসে দেখল, নীলকুঠি আগের মতো নেই। বাড়িটি ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে, যেন এক রাতে সব শেষ হয়ে গেছে।
গ্রামের বয়স্ক একজন বলল, “তুমি খুব ভাগ্যবান যে ফিরে এসেছ। কিন্তু তোমার ছায়া এখনো ওখানেই রয়ে গেছে!”
সে ফিরে গেল শহরে, কিন্তু তার জীবন আর স্বাভাবিক রইল না। প্রতিদিন রাতে সে অনুভব করত, যেন কেউ তাকে অনুসরণ করছে… যেন সে নীলকুঠির সেই কালো ছায়ার অংশ হয়ে গেছে।