A melancholic yet hopeful scene of a young Indian woman in a saree standing near a window, gazing outside with longing. The soft glow of the evening l

অনন্ত অপেক্ষা

মেঘলা আকাশ, একটু ঠাণ্ডা বাতাস, আর একটা খালি স্টেশন। হাওড়ার রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিল নাদিয়া। হাতে ছিল ছোট একটা ব্যাগ, চোখে ছিল এক অদ্ভুত একাকীত্বের ছায়া।

তার জীবনে সবকিছু বদলে গেছে গত কিছু মাসে। পরিবার, বন্ধু, সম্পর্ক—সবই যেন একদিন হঠাৎ হারিয়ে গিয়েছিল। তখন তার মনে হয়েছিল, কী দরকার ছিল এই পৃথিবীকে এমন করে জানতে!

কিন্তু আজ তার জীবনে নতুন একটা দিগন্তের সন্ধান ছিল। সে আসছে কলকাতা থেকে, এক নতুন জীবনের দিকে, তবে এমন এক জীবনে যেখানে প্রত্যেকটা পদক্ষেপ চিন্তা করে ফেলতে হয়।

স্টেশনটিতে খালি বাতাসে তার মন কেমন করে উঠছিল। বহুদিন পরে আবার একা।

হঠাৎ তার ফোন বেজে উঠল।

“নাদিয়া, তুমি ঠিক আছো তো?”

এই কণ্ঠটি তার মনের এক গোপন কোণে বসবাস করত—রোহিত। তারা একসঙ্গে কলেজে পড়াশোনা করত। কিন্তু, অনেক দিন আগে তাদের যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল।

নাদিয়া ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে বলল, “হ্যাঁ, আমি ঠিক আছি। শুধু একটু সময় নিতে চাই।”

“আমরা কি কখনো সত্যিই একে অপরকে বুঝতে পেরেছি, নাদিয়া?” রোহিতের কণ্ঠে কষ্ট ছিল।

নাদিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, মনে পড়ে গেল তাদের সম্পর্কের নানা মধুর স্মৃতি।

“হয়তো না, রোহিত। কিন্তু আমি জানি, এখন বুঝতে হবে।”

ঠিক তখনই, স্টেশনে একটা ট্রেন ঢুকল। তার সঙ্গে যেন একটা অদ্ভুত অনুভূতির জোয়ার এল।

এটা কি একটা নতুন শুরু, নাকি একটা পুরনো ভুলের পুনরাবৃত্তি?

A melancholic Indian woman in a simple yet elegant outfit standing on a quiet train station platform. Her eyes are filled with deep emotions as she gaনাদিয়া ট্রেনের দিকে তাকিয়ে ছিল, চোখের মধ্যে অদ্ভুত এক নিরবতা। রোহিতের ফোনের পর, এক মুহূর্তের জন্য সময় থেমে গিয়েছিল। স্টেশনটা একদম শূন্য হয়ে গিয়েছিল, যেন তার চারপাশে কোনো জীবন্ত অস্তিত্ব নেই।

ফোনটা বন্ধ করে, নাদিয়া ব্যাগটি কাঁধে তুলে নিল। একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ট্রেনের দিকে হাঁটতে শুরু করল।

সামনের দিকে তাকিয়ে, তার মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছিল। রোহিত, তাদের সম্পর্ক, সেই পুরনো কথাগুলো—সব কিছু একসাথে ছুটে আসছিল। তারা যখন শেষবার কথা বলেছিল, তখন থেকেই নাদিয়া জানত, তাদের পথ আলাদা হয়ে গেছে। তবে, কেন যেন কিছু একটা ছিল, যা তাকে বারবার ফিরিয়ে নিয়ে আসছিল।

ট্রেনের দরজা খুলে গেল, নাদিয়া ধীরে ধীরে ঢুকল। সিটে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। মেঘলা আকাশ, কিছু দুরন্ত পাখি—সব কিছু যেন তার জীবনের মিশ্রিত অনুভূতির মতো।

হঠাৎ তার ফোনে আরেকটি মেসেজ এল। রোহিতের লেখা, “তুমি চলে গেছো, কিন্তু আমি জানি তুমি মনের মধ্যে ঠিকই কিছু অনুভব করছো।”

নাদিয়া একটু কাঁপল। সেই শব্দগুলো যেন এক অদ্ভুত বেদনা ছিল।

তার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন আসল, “আমি কি ঠিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছি?”

এটা কি তার জীবনের শেষ পর্বের শুরু, না কি নতুন কিছু যে সে পুরোপুরি অনুধাবন করতে পারছে না?

নাদিয়া ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে লাগল। মেঘগুলো যেন তার মনের মতো ঘনিয়ে উঠছিল। প্রতিটি গাছ, প্রতিটি রাস্তা, তার সমস্ত স্মৃতি একসাথে ভীড়ে উঠছিল। কিন্তু তার কাছে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ছিল—সে কি কখনোই রোহিতকে পুরোপুরি বুঝেছিল? তারা যে সম্পর্কটা ভাগাভাগি করেছিল, সেটা কি আসলে শুদ্ধ ছিল, নাকি শুধু কিছু সময়ের জন্য একে অপরকে প্রয়োজন ছিল?

ট্রেনটি ধীরে ধীরে রেলের ট্র্যাক ধরে এগিয়ে চলছিল। নাদিয়া জানত, সামনে আসা প্রতিটি স্টেশন, প্রতিটি বাঁক তাকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু কী হবে তার সঙ্গে? সেই অসম্পূর্ণ সম্পর্কের ভার সে আর কতক্ষণ বহন করবে?

ফোন আবার বেজে উঠল। এইবার, তার মায়ের ফোন।

“নাদিয়া, তুমি কোথায়?”

নাদিয়া একটু থেমে উত্তর দিল, “স্টেশনে, মায়ের।”

“তুমি কি ঠিক আছো? রোহিতের সাথে আবার যোগাযোগ হয়েছে?”

“হ্যাঁ, কিন্তু আমি জানি না, মা। অনেক কিছু ভেবে তারপর সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”

মায়ের কণ্ঠে একটা চিন্তার সুর ছিল, “তোমার জীবনের সিদ্ধান্ত তুমি নিজেই নিবে, কিন্তু তোমার সুখের জন্য আগে নিজের মনকে শান্ত করতে হবে।”

নাদিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। মা ঠিকই বলেছিল। তার মনের অস্থিরতা, রোহিতের প্রতি টান—এই সমস্ত কিছু মিলে নাদিয়া বুঝতে পারছিল, তার জীবনে কিছু একটা বদলানো প্রয়োজন।

ট্রেনটি তখন একটি ছোট্ট শহরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। এক সময়, এই জায়গাটিতেই রোহিতের সঙ্গে তার প্রথম দেখা হয়েছিল। অনেক বছর আগের সেই দিনগুলি, যখন তারা স্বপ্ন দেখত নতুন কিছু করার, নতুন জায়গায় পৌঁছানোর। কিন্তু এখন সেই সব স্মৃতি যেন এক দুর্বল ছায়ার মতো, যাকে সে আর আগের মতো ধারণ করতে পারে না।

এটা কি স্রেফ অতীতের প্রভাব ছিল, নাকি তার জীবনের নতুন কোনো গতি শুরু হওয়ার পথে?

A quiet train station in a rural setting with a few people standing on the platform. The train has just stopped, and a young Indian woman inside the tট্রেনটি হঠাৎ থেমে গেল। নাদিয়া চোখ কচলে আবার বাইরে তাকাল। অল্প দূরে একটা ছোট্ট স্টেশন দেখা যাচ্ছে, সেখানে কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে ছিল। একটা শান্ত পরিবেশ, যেন সময়ও থেমে গেছে।

স্মৃতি এবং বর্তমানের মধ্যে একটা জটিল গ্লানি নিয়ে, নাদিয়া আবার রোহিতের কথা ভাবল। তাদের শেষ কথা মনে পড়ল, যখন রোহিত বলেছিল, “তুমি কখনো আমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিলে, নাদিয়া। তুমি কি এখনো অনুভব করো, আমাদের মধ্যে কিছু ছিল?”

তার মনের মধ্যে এক ধ্বনি বাজছিল। সে জানত, এর উত্তর একদম সহজ নয়। রোহিতের কাছে ফিরে যাওয়া কি ঠিক হবে? বা, কি সে নিজের মতো নতুন কোনো জীবন শুরু করতে পারে?

ফোনের স্ক্রীনে আবার রোহিতের নাম দেখা গেল। এভাবে বারবার ফোন করা, নাদিয়াকে বিরক্ত করার মতো মনে হলেও, অজানা এক অনুভূতি তাকে ফোনটা ধরতে বাধ্য করল।

“হ্যাঁ, রোহিত?”

“কী ভাবছো?” রোহিতের কণ্ঠে একটা বিরক্তির পাশাপাশি অদৃশ্য এক মাধুর্য ছিল।

“ভেবেচিন্তে তো কিছু বলতে পারব না। হয়তো আমার জীবনের পথে অনেক কিছু নতুন হয়ে গেছে। তুমি তো জানো, আমি কোথায় যাচ্ছি।” নাদিয়া ধীরে ধীরে কথা বলছিল।

“তুমি কি আমাকে পুরোপুরি ভুলে যেতে পারবে, নাদিয়া?”

রোহিতের প্রশ্নে, নাদিয়ার গলা কিছুটা শুকিয়ে গেল। সে জানত, এটা কোনো সহজ প্রশ্ন নয়। এর উত্তরে যতটা সহজ শ্বাস নেওয়া যায়, ততটাই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়।

তার মনে হলো, সে হয়তো রোহিতের সম্পর্ককে অগ্রাহ্য করতে পারবে, কিন্তু তাদের মধ্যে এক অদ্ভুত টান ছিল। সেই টান কি একদিন কমবে, না কি আরও বেড়ে যাবে?

ট্রেন আবার চলতে শুরু করল। নাদিয়া জানত, সে যে পথেই হাঁটুক না কেন, তাকে একদিন এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতেই হবে।

এটা কি কেবল একধরনের মনের অভ্যাস ছিল, নাকি সত্যিই তার জীবনের নতুন দিককে জানিয়ে দেয়া সময় এসে গেছে?

রোহিতের ফোনের পর, নাদিয়া কিছু সময় চুপ করে রইল। ট্রেনের কম্পনের মধ্যে সে যেন নিজের মনে তলিয়ে যাচ্ছিল। এই যে ফোনে কথা বলল, তার মধ্যে কী ছিল? অনুভূতির উত্তাল সাগরে ডুব দিয়ে সে কি ভেবেছিল, আসলেই কি নতুন কিছু তৈরি হবে, নাকি সব কিছু কেবল পুরনো হয়ে যাবে?

ট্রেন একের পর এক স্টেশন পার করছে, কিন্তু নাদিয়া যেন আর কোথাও পৌঁছাতে পারছে না। রোহিতের প্রশ্ন তাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল। “তুমি কি আমাকে ভুলে যেতে পারবে?”—এই প্রশ্ন তার মনের মধ্যে একটা গহীন ঝড় সৃষ্টি করছিল।

এর মাঝে ট্রেনটি হঠাৎ এক জায়গায় থেমে গেল। ছোট একটি শহর, সেখানে কিছু রাস্তা ও পাতা ঢাকা পুকুর। মনে হল, এই জায়গাটা যেন এক গভীর শান্তির স্থান। কিছুটা থমকে গিয়ে নাদিয়া জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছিল। কিছুক্ষণ পর, সে ফোনটা বের করে আবার রোহিতকে কল করল।

“রোহিত, তুমি জানতে চাইছো কি আমি তোমাকে ভুলে যেতে পারব?” নাদিয়া ফোনে বলল, কণ্ঠে যেন একটা নির্জনতা ছিল।

“হ্যাঁ, আমি জানি না তুমি কখনও ভুলতে পারবে, তবে আমি জানতে চাই—তুমি কি আমাদের সম্পর্কটাকে পুরোপুরি কাটিয়ে যেতে পারবে?”

রোহিতের এই প্রশ্নে নাদিয়া দীর্ঘ সময় কিছু বলতে পারল না। তার চোখে মেঘের মতো ভেসে উঠছিল সেই পুরনো দিনগুলি—যখন রোহিত ছিল তার কাছে পৃথিবী। কিন্তু এখন সে জানত, সে আর সেই পৃথিবীতে নেই।

“রোহিত, আমার জীবনের একটা নতুন দিগন্ত খুলছে। তুমি জানো, আমি এটা করব, নাকি ওই পথে ফিরব—তা আমি এখনও জানি না। তবে, এটাই সঠিক সময় আমার জন্য কিছু নতুন করার।”

রোহিত চুপ হয়ে গেল, এরপর খুব আস্তে বলে, “আমি জানি, তুমি যা সিদ্ধান্ত নেবে, সেটা তোমার জন্য ভালো হবে। আমি শুধু চাই, তুমি সুখী হও।”

নাদিয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে ফোনটি কেটে দিল। হৃদয়ে একটা অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করছিল সে। হয়তো সে নিজেকে একটা নতুন জীবনের পথে নিয়ে যেতে পারবে।

ট্রেন আবার চলতে শুরু করল, আর নাদিয়া জানত—এখন সে এক নতুন যাত্রায় পা রাখছে।

এটা কি শুধুই পুরনো সম্পর্কের সমাপ্তি, না কি নতুন একটি অধ্যায়ের সূচনা?

নাদিয়া এখন জানত, জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে চলেছে। ট্রেনের মধ্যে, সেই মৃদু কম্পন আর বাইরে দেখতে থাকা একনিষ্ঠ দৃশ্য তার মনের মধ্যে এক অদ্ভুত শান্তি এনে দিচ্ছিল। ফোনের পর, রোহিতের কথা ভাবতে ভাবতে, তার মনের মধ্যে কিছু পরিবর্তন ঘটছিল।

সে জানত, যে পথ সে বেছে নিতে চলেছে, তা একেবারে সহজ নয়। কিন্তু, তার মনের ভেতর এক নতুন শক্তি, এক নতুন আকাঙ্ক্ষা জন্ম নিয়েছিল। সে আর পুরনো সম্পর্ককে আর পিছনে ফেলে রাখতে চায়নি। এখন তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, নিজের জন্য কিছু করা—নিজের জন্য, এক নতুন শুরু।

স্টেশনগুলো একে একে পেরিয়ে যাচ্ছিল, আর নাদিয়া তার জীবনকে সামনে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে আরও দৃঢ় হচ্ছিল। এত দিন পর্যন্ত, সে যা কিছু করেছে, তা ছিল অন্যদের জন্য—পারিবারিক চাহিদা, সামাজিক প্রভাব, বন্ধুত্ব। কিন্তু আজ, আজ সে বুঝতে পারল যে, একদিন তার জীবন তার নিজের হতে হবে।

ট্রেনটি যখন শেষ স্টেশনে পৌঁছাল, নাদিয়া ভাবল, এই ট্রিপের শেষে সে কী পাবে? তবে সে জানত, তার খুঁজে চলা পথ ঠিক কোথায় যাবে, সেটাও তার নিজের হাতে।

স্টেশন থেকে নেমে, সে কয়েকটি পা বাড়াল। তার কাছে মনে হচ্ছিল, প্রতিটি পদক্ষেপ যেন তার জীবনকে নতুন করে তৈরির অংশ। যদিও সে জানত না ঠিক কী হবে, কিন্তু এখন তাকে আর কোনো কিছুই দমাতে পারবে না।

তবে, এই পথ ধরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে, তার সামনে আরও অনেক প্রশ্ন আসবে। সেই প্রশ্নের উত্তর তাকে একদিন নিজেই দিতে হবে।

এখন, নাদিয়া জানে, তার জীবন তার নিজস্ব হাতে।

এটা কি এক নতুন সূচনা, নাকি পুরনো দ্বন্দ্বের পরিপূর্ণ সমাপ্তি?

(শেষ) 😏

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *