নীহারিকা ছোট থেকেই সংসার সামলাতে শিখেছে। বিয়ে হয়ে আসার পর থেকে স্বামী অমিতেশ বিদেশে চাকরি করে, আর সে একাই এই ফ্ল্যাটে থাকে। একসময় ফোন, ভিডিও কল, মেসেজ—সবকিছুই চলত ঠিকঠাক, কিন্তু ধীরে ধীরে সব কমতে শুরু করল। এখন হয়তো সপ্তাহে একবার কথা হয়, তাও খুব সংক্ষিপ্ত।
একদিন সন্ধ্যায় ফ্ল্যাটের সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল নীহারিকা। হঠাৎ পাশের ফ্ল্যাটের নবদীপ ডাকল, “নীহারিকা, একা একা কী ভাবছো?”
— “এমনি… কিছু না।”
নবদীপ মুচকি হাসল, “এই এমনি কথাটার মানে খুব গভীর হয় জানো?”
নীহারিকা একটু হেসে বলল, “সবকিছুর মানে খোঁজা কি জরুরি?”
নবদীপ চোখে একরাশ কৌতূহল নিয়ে বলল, “সবাই তো অভ্যাসের জালে আটকে থাকে, কেউ কেউ সেই জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে… তুমি কোন দলে?”
নীহারিকার বুকের মধ্যে কেমন একটা কাঁপন উঠল। ও কি সত্যিই কোনো জালে আটকে আছে?
নীহারিকা নবদীপের কথার উত্তর দিল না, শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। এই প্রশ্নের উত্তর কি এত সহজ?
অমিতেশের সঙ্গে ওর সম্পর্কটা কি ভালোবাসার? নাকি কেবলই একটা অভ্যাস?
পরের দিন সন্ধ্যায় দরজার বেল বেজে উঠল। দরজা খুলে দেখে নবদীপ দাঁড়িয়ে আছে, হাতে কফির কাপ।
— “একটু হাঁটবে? সারাদিন তো ঘরেই থাকো।”
নীহারিকা প্রথমে না বলতে চেয়েছিল, কিন্তু না বলতে পারল না।
ফাঁকা রাস্তা, হালকা বাতাস… দু’জনে পাশাপাশি হাঁটছিল।
— “তোমার হাসিটা আজকাল খুব ম্লান লাগে,” নবদীপ বলল।
নীহারিকা মৃদু হেসে বলল, “হাসি কি শুধু আনন্দের হয়?”
— “হাসি হয় অনুভূতিরও। কিন্তু সেটা অনুভব করার মানুষ থাকতে হয় পাশে।”
নীহারিকার বুকের মধ্যে অদ্ভুত এক শিহরণ উঠল।
ও কি ভুল করছে? নাকি, অনেকদিন পর কিছু সত্যি অনুভব করছে?
নীহারিকা আর নবদীপ রাস্তা দিয়ে ধীর পায়ে হাঁটছিল। শহরের বাতাসে হালকা শীতলতা, গলির ধারের আলো মিটমিট করে জ্বলছে।
— “তোমার ভয় করছে?” নবদীপ হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল।
নীহারিকা চমকে তাকাল, “কেন? কিসের ভয়?”
নবদীপ মুচকি হাসল, “অচেনা অনুভূতির ভয়। যেটা হয়তো তুমি আগে কখনো অনুভব করোনি, কিন্তু এখন সেটা একটু একটু করে তোমার মনে জায়গা করে নিচ্ছে।”
নীহারিকা চোখ নামিয়ে নিল। সত্যিই কি ওর ভেতরে কিছু একটা বদলাচ্ছে?
— “তুমি সবসময় এত গভীর কথা বলো কেন?”
— “কারণ আমি গভীরতাকেই দেখতে শিখেছি,” নবদীপ মৃদু গলায় বলল।
নীহারিকা কিছু বলল না। শুধু অনুভব করল, ওর মনের কোথাও একটা নতুন দরজা খুলছে…
কিন্তু সেই দরজার ওপাশে কী আছে?
নীহারিকা মনে মনে স্বীকার করতে চাইছিল না, কিন্তু ও বুঝতে পারছিল— কিছু একটা বদলে যাচ্ছে।
নবদীপের কথাগুলো ওর মনের গহীনে কোথায় যেন ধাক্কা দিচ্ছে। এত বছর ধরে সে শুধু সংসার আর অপেক্ষার ফাঁদে আটকে থেকেছে। কিন্তু আজকাল, নবদীপের সঙ্গ পেলে ওর মন হালকা লাগে।
একদিন দুপুরে অমিতেশের ফোন এল।
— “কেমন আছো?”
নীহারিকা একটু হেসে বলল, “ভালো। তুমি কবে আসবে?”
— “এবার মনে হয় আসতে দেরি হবে, কাজের চাপ প্রচণ্ড।”
নীহারিকা কিছু বলল না। একসময় অমিতেশের এই কথাগুলো শুনলে মন খারাপ লাগত, চোখ ভিজে আসত। কিন্তু আজ? আজ ওর মন শূন্য… যেন কিছুই অনুভব করছে না।
সন্ধ্যায় ছাদে গিয়েছিল নীহারিকা। নবদীপ পাশে এসে দাঁড়াল।
— “আজ চুপচাপ কেন?”
নীহারিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “জানি না… মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি কি সত্যিই কারও জন্য গুরুত্বপূর্ণ? নাকি শুধু একটা অভ্যাস হয়ে গেছি?”
নবদীপ ধীরে ধীরে বলল, “যদি শুধুই অভ্যাস হও, তাহলে কি সেটা ভাঙার সময় আসেনি?”
নীহারিকার হৃদয় কেঁপে উঠল।
ও কি সত্যিই নতুন করে ভাবতে প্রস্তুত? নাকি, ও এখনো পুরনো শিকলে বাঁধা?
নীহারিকা নবদীপের কথার উত্তর দিল না, শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল।
একটা সময় ছিল, যখন অমিতেশের ফোনের অপেক্ষায় দিন কাটত। এখন ফোন এলেও তেমন অনুভূতি হয় না।
নবদীপ ধীরে ধীরে বলল, “একটা প্রশ্ন করব?”
নীহারিকা তাকাল ওর দিকে।
— “তুমি কি সত্যিই সুখী?”
প্রশ্নটা খুব সহজ, কিন্তু উত্তরটা?
নীহারিকা মৃদু হাসল, “সুখ আসলে কাকে বলে নবদীপ?”
— “সুখ মানে, এমন একটা অনুভূতি, যেখানে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে।”
নীহারিকার বুকের ভেতর কেমন যেন একটা কাঁপন উঠল।
— “তাহলে, আমি জানি না আমি সুখী কি না।”
নবদীপ গভীর চোখে তাকাল, “তাহলে এটা খুঁজে বের করার সময় এসেছে, নীহারিকা।”
ওর কণ্ঠে যেন একধরনের চ্যালেঞ্জ।
নীহারিকা কি সত্যিই নিজের সুখের মানে খুঁজতে পারবে?
নাকি, পুরনো অভ্যাসের বাঁধনেই আটকে থাকবে?
নীহারিকা সেদিন রাতে ঘুমোতে পারল না। নবদীপের কথাগুলো মনের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিল।
সত্যিই কি ও সুখী?
এতদিন শুধু অভ্যাসের মধ্যে বেঁচে ছিল, ভালোবাসার খোঁজ করেনি। কিন্তু নবদীপের সঙ্গে কাটানো সময়গুলো যেন ওকে প্রশ্ন করতে শিখিয়েছে— ও কি সত্যিই বেঁচে আছে, নাকি শুধু টিকে আছে?
পরের দিন বিকেলে নবদীপের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল নীহারিকা।
নবদীপ হাসল, “এত চিন্তিত লাগছে কেন?”
নীহারিকা ধীরে ধীরে বলল, “আমি যদি বলি… আমি আমার অনুভূতিগুলো বুঝতে পারছি না?”
নবদীপ একটু কাছে এসে বলল, “তাহলে ওগুলো বুঝতে সময় নাও। তবে নিজেকে মিথ্যে বলে বোঝানোর দরকার নেই।”
নীহারিকা চোখ নামিয়ে নিল।
কিন্তু সত্যিটা কী?
ও কি নতুন কিছু অনুভব করছে? নাকি, শুধুই একাকীত্ব থেকে পালানোর চেষ্টা?
নীহারিকা কি সাহস করে নিজের মনের কথা স্বীকার করতে পারবে?
নীহারিকা জানে, একসময় না একসময় এই প্রশ্নের উত্তর দিতেই হবে।
কিন্তু কাকে? নবদীপকে? নাকি নিজেকেই?
সেদিন সন্ধ্যায় অমিতেশের ফোন এল।
— “আজ একটু দেরি হয়ে গেল, অফিসে প্রচণ্ড চাপ ছিল। তুমি কী করছিলে?”
নীহারিকা ফোনের ওপাশে নীরব হয়ে থাকল কিছুক্ষণ, তারপর বলল, “আকাশ দেখছিলাম।”
— “আকাশ? তুমি এসব কখন থেকে করো?”
— “যেদিন থেকে বুঝেছি, আমার জীবনে অনেক শূন্যতা আছে।”
ওপাশে কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর অমিতেশ বলল, “তুমি ঠিক আছো তো?”
নীহারিকা একটু হেসে বলল, “হ্যাঁ, আমি ভালো আছি। এখন সত্যি সত্যি বুঝতে শুরু করেছি, আমি কী চাই।”
সেদিন রাতে, নবদীপের মেসেজ এল—
“তুমি কি তোমার জবাব খুঁজে পেয়েছো?”
নীহারিকা ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকল। ও জানে, উত্তরের খুব কাছে চলে এসেছে…
কিন্তু ও কি সত্যিই সেই উত্তরটা বলার জন্য তৈরি?
নীহারিকা অনেকক্ষণ ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকল। নবদীপের মেসেজটা ছোট, কিন্তু ওর মনের গহীনে তোলপাড় করে দিল।
“তুমি কি তোমার জবাব খুঁজে পেয়েছো?”
ও কি পেয়েছে?
রাত গভীর, শহরের বাতাস কেমন একটা নরম গন্ধ বয়ে আনছে। মনে হলো, অনেকদিন পর ও নিজের ভেতরের সত্যিটাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে।
সকালে নবদীপকে ফোন করল। ওপাশ থেকে চেনা কণ্ঠ ভেসে এল—
— “নীহারিকা?”
— “হ্যাঁ, আমি আমার উত্তর পেয়ে গেছি, নবদীপ।”
— “তাহলে বলো।”
— “আমি বাঁচতে চাই। আমি শুধু অপেক্ষা করে কাটিয়ে দিতে চাই না। আমি এমন একটা জীবন চাই, যেখানে আমি অনুভব করতে পারব, যেখানে আমি হাসতে পারব… যেখানে আমি সত্যি নিজের মতো করে থাকতে পারব।”
ওপাশ থেকে নবদীপ চুপ। কয়েক সেকেন্ডের নিস্তব্ধতা।
তারপর, খুব ধীর গলায় বলল, “তাহলে এবার সাহস করো, নীহারিকা। নিজের জন্য বাঁচো।”
নীহারিকার মনে হলো, ও সত্যিই একটা শেকল খুলে ফেলেছে।
কিন্তু এরপর? এরপর কী করবে?
নীহারিকা জানে, এবার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে।
অমিতেশের জন্য ওর ভালোবাসা ছিল, সন্দেহ নেই। কিন্তু ভালোবাসা আর অভ্যাসের মধ্যে যে সূক্ষ্ম পার্থক্য, সেটা বুঝতে ওর অনেক সময় লেগেছে।
সন্ধ্যায় নবদীপের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল ও। নবদীপ ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
— “আজ তোমার চোখে একটা অদ্ভুত শান্তি দেখছি।”
নীহারিকা মৃদু হাসল, “কারণ আমি বুঝতে পেরেছি, আমি আর আগের মতো নেই।”
— “তাহলে এবার কী করবে?” নবদীপ একটু কাছে এগিয়ে এলো।
নীহারিকা এক গভীর শ্বাস নিয়ে বলল,
— “আমি আমার জীবনটা নতুন করে শুরু করব। নিজের মতো করে, নিজের জন্য। এবার আমি শুধু কারো অপেক্ষায় সময় নষ্ট করব না।”
নবদীপের চোখে একরাশ প্রশংসা ফুটে উঠল।
— “তাহলে তোমার পথচলার শুরুতে আমি একটা প্রশ্ন করতে চাই…”
নীহারিকা চমকে তাকাল, “কী প্রশ্ন?”
নবদীপ চোখে চোখ রেখে বলল,
— “আমি কি তোমার পাশে থাকতে পারি?”
নীহারিকার হৃদয় মুহূর্তের জন্য থমকে গেল।
এটা কি নতুন শুরুর ইঙ্গিত?
নাকি, আরেকটি অচেনা অনুভূতির শুরু?
নীহারিকা নবদীপের চোখে তাকিয়ে রইল।
ওর মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল। “আমি কি সত্যিই প্রস্তুত? আমি কি আবার নতুন করে কাউকে জায়গা দিতে পারব?”
নবদীপ ধীরে ধীরে বলল, “ভয় পাচ্ছো?”
নীহারিকা মৃদু হেসে বলল, “হয়তো… বা হয়তো এটা নতুন কিছু অনুভব করার ভয়।”
নবদীপ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “আমি জানি, তোমার জন্য এটা সহজ নয়। কিন্তু একটা কথা বলো, তুমি কি সত্যিই নিজের জন্য একটা নতুন জীবন চাইছো?”
নীহারিকা চোখ বন্ধ করল। অনেকগুলো পুরনো মুহূর্ত সামনে ভেসে উঠল—একাকীত্ব, অপেক্ষা, অভ্যাসের নামের ভালোবাসা, ফাঁকা অনুভূতি…
তারপর ধীরে ধীরে চোখ খুলে বলল, “হ্যাঁ, আমি নতুন করে বাঁচতে চাই।”
নবদীপ মুচকি হাসল, “তাহলে ভয় পেয়ো না। জীবন একবারই পাওয়া যায়, সেটা পুরোপুরি নিজের মতো করে বাঁচো।”
সন্ধ্যার বাতাসে ওর চুল উড়ছিল, আর ওর মনের মধ্যে একটা নতুন অনুভূতি জন্ম নিচ্ছিল।
এটা কি ভালোবাসা? নাকি শুধুই মুক্তির স্বাদ?
উত্তরটা হয়তো সময়ই দেবে…
(সমাপ্ত।) 😏🔥
গল্পটা এখানে শেষ। কিন্তু জীবন তো কখনো সত্যি শেষ হয় না, তাই না?
নীহারিকা কি সত্যিই নতুন করে জীবন শুরু করবে?
নবদীপ কি ওর পাশে থাকবে, নাকি সময়ের সঙ্গে বদলে যাবে সবকিছু?
অমিতেশ কি একদিন ফিরে এসে বুঝতে পারবে, সে কতটা দূরে সরে গিয়েছিল?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর সময়ই দেবে…
হয়তো এটা আরেকটা গল্পের শুরু।
নাকি, তোমার মনে অন্য কোনো শেষ আছে এই কাহিনির জন্য? 😉🔥